আজ ২২ আগস্ট কাঙ্খিত সেই প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা। এ লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতিও নেয় বাংলাদেশ। অভিযোগ উঠেছে, তালিকাভুক্ত অনেকেরই মিয়ানমারে ফেরার ইচ্ছা আছে। তবে, রোহিঙ্গা নেতারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে গেছে তারা যেন ফিরতে রাজি না হয়। এমনকি ফিরতে রাজি হওয়া তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের কয়েকটি পরিবার এখন খোঁজ মিলছে না।
এ অবস্থায় আজ আদৌ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে কিনা- তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা অবশ্য জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আশাবাদী তারা।
ইতোমধ্যে টেকনাফের ঘুমধুম সীমান্ত ও টেকনাফের কেরুনতলী সীমান্ত প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নেয়া হয়েছে নিñিদ্র নিরাপত্ত ব্যবস্থা। সবার দৃষ্টি এখন ঘুমধুম ও কেরুনতলী সীমান্তে। প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা ফেরত দেখতে উন্মুখ তারা।
এদিকে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই বলে আসছে কোনো রোহিঙ্গাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না। তবে, বুধবার (২১ আগস্ট) পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ১ হাজার ৩৩ পরিবারের মধ্যে যে ২৩৫ পরিবার ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছে- তাদের মধ্যে প্রায় সবাই মিয়ানমারে ফিরবে না বলে মত দিয়েছে।
আবার তালিকাভুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ মিয়ানমারে যেতে রাজি হলেও রোহিঙ্গা নেতাদের চাপে না বলতে বাধ্য হচ্ছেন। এরপরও যারা রাজি হচ্ছেন তাদের ক্যাম্প থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে প্রত্যাবাসন বিরোধী চক্র।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তারা রাজি থাকলে বাসে করে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এজন্য ঘুমধুম সীমান্তে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। তবে, রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি হচ্ছে না। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।
এদিকে, প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা বলছেন, কোন ভরসায় তারা মিয়ানমারে যাবে? যে নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, আবারো সেই নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে- এমন ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। তবে, মিয়ানমার সরকার যদি তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নাগরিকত্ব দেয়, মিয়ানমারে চলাফেরা করার স্বাধীনতা দেয়, রোহিঙ্গা হত্যার বিচার করে, সেখানে জেলে বন্দি থাকা রোহিঙ্গাদের মুক্তি দেয় এবং তাদের বসতভিটা ফেরত দেয়- তাহলেই ফিরতে রাজি তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গা টেকনাফের ২৪, ২৫, ২৬, ২৭ নম্বর ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। তবে, নয়াপাড়ার ২৬ ও জাদিমুড়ার ২৭ নম্বর ক্যাম্পে অবস্থান করছেন ৩ হাজার ৩০০ জন রোহিঙ্গা।
এজন্য ক্যাম্প দুটির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। এজন্য গত মঙ্গলবার ও বুধবার ২৩৫ পরিবারের মতামত জানা হয়েছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা মিয়ানমার ফিরবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই-৩ ব্লুকের বাসিন্দা মো. আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে মিয়ানমার ফিরতে চাই কিনা। আমি একবাক্যে ‘যাব না’ বলে জানিয়ে এসেছি। কারণ যে নির্যাতনের শিকার হয়ে আমরা নিজ দেশ ছেড়ে এসেছি আবার সেই নির্যাতনের মুখে পড়তে চাই না।
এক প্রশ্নের জবাবে শরণার্থী বলেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমরা খুব ভালো আছি। এই সুখের জায়গা ছেড়ে সন্তানদের হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাই না। তবে, মিয়ানমার সরকার যদি আমাদের নাগরিকত্ব দেয়, চলাফেরার স্বাধীনতা দেয় তাহলে ফিরতে আপত্তি নেই। যতই হোক এটি পরের দেশ। নিজেদের ভিটেমাটিতে শান্তিতে থাকার ইচ্ছা সবারই আছে।
ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে বের হয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, তালিকাভুক্ত অনেকেরই মিয়ানমারে ফেরার ইচ্ছা আছে। তবে, রোহিঙ্গা নেতারা বাড়িতে এসে জানিয়ে গেছে ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে গিয়ে যেন বলি, ‘আমরা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নই’। তাই আমরা ফিরতে রাজি নই বলে জানিয়ে এসেছি। কারণ এরপরও যদি ফেরার কথা বলি; তাহলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে।
অন্যদিকে, ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে কর্মরত এনজিও কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, তালিকাভুক্তদের মধ্যে ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই ব্লুকের কয়েকটি পরিবার মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হয়েছে। পরে এ প্রতিবেদক গতকাল দুপুরে ওই বাড়িগুলোতে গেলে সেগুলো ফাঁকা পাওয়া যায়। রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, মিয়ানমারে যেতে রাজি হওয়ায় তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রভাবশালী রোহিঙ্গাচক্র।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কমিশনার আবুল কালাম বলেন, মঙ্গলবার ২১ ও গতকাল বুধবার ২১৪ পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের পরিবহনের জন্য পাঁচটি বাস ও তিনটি ট্রাকের ব্যবস্থাসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমরা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশাবাদী। ইতোমধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য মিয়ানমার ও চীনের তিনজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হবে। তারা ইতোমধ্যে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। এখন শুধু রোহিঙ্গারা রাজি থাকলে আজ বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) থেকেই প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা হলেও মিয়ানমারের নানা টালবাহানায় তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন দুদেশের কর্মকর্তারা। মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের একটি তালিকাও হস্তান্তর করেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। মিয়ানমার নাগরিকদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার দুবছর পূর্তি সামনে, তাই আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার ঘোষণা দেয় মিয়ানমার।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের ৩০টি সীমান্তচৌকিতে একযোগে হামলার পর মিয়ানমার বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের মুখে দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। এরপর বেশ কয়েক দফা আলোচনা ও সমঝোতা চুক্তি সই করা হলেও এখনো শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭ জন। এরা সবাই মিয়ানমারের নাগরিক।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.