Take a fresh look at your lifestyle.

দেউলিয়া হওয়ার পথে ইভ্যালি!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

দিন যত গড়াচ্ছে- ততই বাড়ছে দেনা। চোখ ধাঁধানো অফারে গ্রাহকের মনোযোগ আর্কষণ করে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দেনা বাড়ছে। তবে গ্রাহকরা সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দেয়া ভাউচারও ক্যাশ করা যাচ্ছে না। রিফান্ড করার কথা বলে মাস পেরিয়ে গেলেও ইভ্যালির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। দেশে ডিজিটাল ই-কর্মাসের নামে এসব প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে ইভ্যালি। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর সব তথ্য। এতে দেখা গেছে কোম্পানির সম্পদের তুলনায় দায়ের পরিমাণ প্রায় ৬ গুণেরও বেশি। এতে নড়েচড়ে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে ইভ্যালিসহ সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহের আগে অর্থ নেয়া বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ইভ্যালির গ্রাহক হয়রানির অভিযোগের পাহাড় জমেছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুএকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স খাতের ক্ষতি মেনে নেয়া যায় না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মেহেদি হাসান। ইভ্যালির চোখ ধাঁধানো অফারে মুগ্ধ হয়ে একটি এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ও এয়ারফোনের অর্ডার করেন ইভ্যালিতে। মোবাইলের বাজারদর ২৮ হাজার টাকা হলেও ইভ্যালি ছাড় দিয়ে মোবাইল ফোনের দাম নির্ধারণ করে সাড়ে ১৭ হাজার টাকা। আর ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেয়া হবে বলে অফারে উল্লেখ করা হয়। নগদের মাধ্যমে সাড়ে ১৭ হাজার টাকা পরিশোধ করার ৭২ দিন পর ইভ্যালির পক্ষ থেকে জানানো হয়, মোবাইল দেবে না, ফোন সেটটির বাজারমূল্যে রিফান্ড করবে। এরপরও একমাস পেরিয়ে গেলেও ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না মেহেদি হাসান। এ তো শুধু মেহেদী হাসানের কথা। এরকম হাজার হাজার গ্রাহক ফোনসেট, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্যের টাকা পরিশোধ করেও পণ্য পাচ্ছেন না। ‘সাইক্লোন’ থেকে শুরু করে কদিন পর পরই বিভিন্ন অফারে গ্রাহকের সঙ্গে অগ্রিম টাকা নিয়ে প্রতারণা করছে ইভ্যালি। এর শত শত অভিযোগ পড়ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে।

ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেলের পৈতৃক নিবাস সাভারের বনগাঁও ইউনিয়নের বলিয়াপুর কুণ্ডা ব্রিজের কাছেই। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময়ে সেকেন্ড হ্যান্ড বাস-ট্রাক গাড়ি কেনাবেচার কাজ করতেন রাসেলের পিতা প্রয়াত আলে মহাজন। বলার মতো সম্পদ না থাকলেও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠা করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন রাসেল। তার এসব গল্প শুনে অবাক এলাকার অনেকে। বলিয়াপুরে কথা হয়, আলে মহাজনের এক প্রতিবেশীর সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, আলে মহাজন পুরনো বাস-ট্রাক বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার সম্পদ বলতে উল্লেখ করার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু রাসেলের বর্তমান সম্পদের কথা শুনে রীতিমতো অবাক তিনি।

জানা গেছে, ইভ্যালি প্রতারণার উদ্দেশ্যে চোখ ধাঁধানো নানা অফার ঘোষণা করে। পণ্যের নির্ধারিত দামের অর্ধেক মূল্য ছাড়ের ঘোষণা দিয়ে অগ্রিম টাকা নেয় ইভ্যালি। এতে ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারির কথা থাকলেও তিন মাসেও অনেকে পাননি পণ্য। ইভ্যালি মূলত আলোচনায় আসে মোটরসাইকেলের অফারে। নির্ধারিত দামের প্রায় অর্ধেকে বাজাজের পালসার বাইকের অফারে হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রাহকরা। এতে ৪৫ দিনের সময়সীমা দিলেও তিন মাস পরও অনেকে সরবরাহ পাননি। আর যারা তিন মাসের মধ্যে পণ্য পেয়েছেন, তাদেরও পণ্যের বাজারমূল্য অফার করা হয়। এতে দিগুণ লাভের আশায় বাইকের শত শত অর্ডার আসতে থাকে ইভ্যালিতে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে থাকে ইভ্যালি। আর এসব চুক্তি ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। এতে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি হতে থাকে ইভ্যালির। অথচ কোনো ওয়্যার হাউস পর্যন্ত নেই প্রতিষ্ঠানটির। এখানেই শেষ নয়; গ্রাহকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে নামিদামি সব তারকাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করে ইভ্যালি।

ইভ্যালির এই প্রতারণা থেকে মুক্তি পেতে গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, অনেক অভিযোগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। তবে তুলনামূলক বেশি অভিযোগ আসছে ইভ্যালির নামে। ফাল্গুনী নামে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে একটি মামলা করেছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আরো অনেক অভিযোগ মামলা করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা; যেখানে কোম্পানিটির চলতি সম্পদ মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মাত্র ৬৫ কোটি টাকার চলতি সম্পদ দিয়ে কোনো অবস্থাতেই কোম্পানিটির এই দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা নেই।

চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। অন্যদিকে, ইভ্যালি যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে- ওই সব ব্যবসায়ীদের কাছে কোম্পানিটির বকেয়া ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ, ইভ্যালির সব চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে এবং আরো ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব হবে। ইভ্যালির চলতি দায় ও লোকসান দুটিই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং কোম্পানিটি চলতি দায় ও লোকসানের দুষ্ট চক্রে বাধা পড়েছে। ক্রমাগতভাবে সৃষ্ট দায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব টিকে না থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর বছর থেকেই ইভ্যালি লোকসানে রয়েছে এবং দিন দিন এর লোকসান বাড়ছে। প্রথম বছর কোম্পানিটির নিট লোকসান ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। গত ১৪ মার্চ কোম্পানিটির পুঞ্জীভ‚ত লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে কথা বলতে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের সেল ফোনে বারবার কল দেয়ার পরও রিসিভ করেননি তিনি। পরবর্তীতে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পরও তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের এসব অনিয়ম বন্ধে গত বৃহস্পতিবার ই-কমার্স এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকে গ্রাহকের অগ্রিম অর্থ আর কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সরাসরি পাবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গ্রাহকের স্বার্থে তৃতীয় পক্ষের কাছে এই অর্থ জমা থাকবে। পণ্য ডেলিভারির পরই সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অর্থ পাবে বলেও জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া ইভ্যালির এসব অনিয়মের কারণে ইতোমধ্যে ইভ্যালি, আলেশা মার্টসহ ১০টি অনলাইন মার্চেন্টে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন স্থ?গিত করেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি)।

এর আগে ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ঢাকা ব্যাংক একই নিষেধাজ্ঞা দেয়। পাশাপাশি ইউসিবি ও সিটি ব্যাংকও তাদের গ্রাহকদের এসব অনলাইন মার্চেন্টে লেনদেনের বিষয়ে সতর্ক করেছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডি।

ইভ্যালি সূত্রে জানা গেছে, অনলাইনভিত্তিক কোম্পানিটির মোট গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৪ জন। ক্রয়াদেশ বাতিল, ইভ্যালির দেয়া ক্যাশব্যাক, বিক্রিত গিফটকার্ডের সমন্বয়ে এসব গ্রাহকদের ইভ্যালি ভার্চুয়াল আইডিতে (একাউন্ট, হোল্ডিং, গিফটকার্ড, ক্যাশব্যাক) মোট ৭৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা মূল্যমানের ই-ভ্যালু সংরক্ষিত ছিল। অথচ ওই দিন শেষে ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের ১০টি ব্যাংক হিসাবে মোট ২ কোটি ০৪ লাখ টাকা জমা ছিল। ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের কর্মকাণ্ডে সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, লোকসানে পণ্য বিক্রি করার কারণে ইভ্যালি গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নেয়ার পরও ব্যবসায়ীদের কাছে বকেয়া অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।

এ বিষয়ে ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার সংবাদিকদের বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি ই-কমার্স আইন ও স্ক্রো সেবা চালুর। যেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা যায়। স্ক্রো সেবা চালুর মাধ্যমে ক্রেতার আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা দেয়া যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায়ও আমরা বিষয়টি উত্থাপন করেছি। আশা করছি আইনি প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে এসওপি ঘোষণা করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব স্ক্রো সেবা যুক্ত করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

%d bloggers like this: