সরকার ও প্রশাসনে গুরুত্ব হারাচ্ছেন রাজনীতিকরা। দাপট বাড়ছে আমলাদের-এমন আলোচনা চলছে বেশি কিছুদিন ধরেই। অভিযোগও ওঠেছে নানা পর্যায় থেকে। শেষমেশ বিষয়টি গড়িয়েছে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করে উগড়ে দিয়েছেন ক্ষোভ। তাদের বক্তব্য- করোনা ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অহেতুক নাক গলাচ্ছেন আমলারা। সরকারও জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব না দিয়ে ভরসা রাখছে আমলাদের ওপর। বিশ্লেষকরাও মনে করেন, আমলাদের দাপটে সরকারের কর্মকাণ্ডে রাজনীতিক-জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব ও সম্পৃক্ততা অনেকটাই কমে গেছে। তবে এমন দাবি মানতে নারাজ সরকার।
জাতীয় সংসদে গত সোমবার ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় করোনা প্রতিরোধে জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ও সরকারি কার্যক্রম সমন্বয় করতে সচিবদের দায়িত্ব দেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সরকারি দলের প্রবীণ সাংসদ ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি অভিযোগ করেন, এতে রাজনীতিবিদের কর্তৃত্ব ম্লান হয়েছে। আর দায়িত্ব দেয়া হলেও সচিবদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট জেলায় যাননি। তোফায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, আজকে দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছেন। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এই দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিলেন। সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের এক দশকেও রাজনীতি করা কঠিনই হয়ে গিয়েছিল। দেশ চালাতেন সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। বর্তমানেও আমলাতন্ত্রের দাপটে পেছনের সারিতে রাজনীতিবিদরা। আমলাতন্ত্রের ওপর সরকারের অতিরিক্ত নির্ভরতা রাজনীতিকদের কর্তৃত্ব এবং সাফল্যকে ম্লান করে তুলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, কোভিডের আগে থেকেই রাজনীতিকরা ধীরে ধীরে জায়গা হারাচ্ছিলেন। আর সেই জায়গা দখল করেছিলেন আমলারা। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই আমলাদের এই দাপট লক্ষণীয়। কোভিডে সরকারি সহায়তা কার্যক্রমও আমলাদের দিয়ে চালানো হচ্ছে। ফলে আমলারা সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। এটি রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। এতে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
রাজনীতিতে আমলাতন্ত্রের উত্থান এবং রাজনীতিবিদদের সাইডলাইনে চলে যাওয়াকে রাষ্টের জন্য অশনিসংকেত হিসেবেই দেখছেন রাজনীতিবিদদের অনেকেই। তাদের মতে, রাজনীতি থাকবে রাজনীতিবিদদের হাতে, আমলাদের হাতে নয়। আমলারা জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ পালন করবেন। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে রাজনীতি থেকে রাজনীতিবিদদের বিদায় ঘণ্টা বাজতে বেশি সময় লাগবে না। অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র তার বৈশিষ্ট্য হারাবে।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমলাতন্ত্রের দাপটে রাজনীতিবিদরা গুরুত্ব হারাচ্ছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ওয়ান ইলেভেনের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা সরকারও রাজনীতিকে বিরাজনীতি করছেন। বিরোধী দলকে কথা বলতে দিচ্ছেন না। নিজ দলের নেতাদেরও কোণঠাসা করে আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। এটি রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। কোথাও গণতন্ত্র নেই। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাহীন করে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তাই দিন দিন রাজনীতিবিদরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগও কি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে- এমন প্রশ্ন নানা মহলের। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষের বিভিন্ন কর্মসূচি ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় আমলাদের প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি দলের আমলা নির্ভরতা হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি বিভিন্ন নির্বাচনে আমলাদের দলীয় মনোনয়ন দেয়াসহ সরকারি প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেয়া নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, আমলায়নের কারণে বর্তমানে রাজনীতিবিদরা একটু সাইডলাইনে। কয়েক বছর ধরেই এটি চলছে। তবে কোভিডকালে সরকার আমলাদের ওপর একটু বেশিই নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের জন্য আমলা লাগবে, আমলাতন্ত্র থাকবে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক আমলায়নের প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, রাজনীতি থাকবে রাজনীতিবিদের হাতে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমলারা জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন। এটি মেনে নিলে জাতীয় কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকে রাজনীতিবিদদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন? আওয়ামী লীগ কীভাবে আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে, এটি বোধগম্য নয়। তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী রয়েছে। অদক্ষ ও দুর্নীতির সিলমোহর দিয়ে তাদের সাইডলাইনে রাখা কি অসচেতনতার জন্য- এমন প্রশ্ন এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর।
তবে আওয়ামী লীগ মোটেই আমলানির্ভর নয় বরং লাখ লাখ তৃণমূল কর্মীর সুশৃঙ্খল দল-এমন দাবি সরকারদলীয় নেতাদের। তাদের মতে, আমলাদের তুলনায় রাজনীতিবিদরা জনগণের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত এবং দক্ষ। আমলাতন্ত্রের সময়ক্ষেপণের কারণে উন্নয়নে সময় বেশি লাগছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, আমলারা আমলাদের জায়গায়; আর রাজনীতিবিদরা রাজনীতির জায়গায়। একথা ঠিক, আমলাদের আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অনেক বেশি দক্ষ। গত ৭০ বছরে এই বাংলার রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে ভাষা রক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশ স্বাধীন হয়েছে। গত ৫০ বছরে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্র দক্ষ হলে এই উন্নয়ন আরো দ্রুত হতো। রাজনীতি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন আমলারা। কিন্তু আমলাদের সময়ক্ষেপণের কারণে উন্নয়ন কাজ পিছিয়ে যায়। আমলারা ততটা দক্ষ নন বলে মনে করেন সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী।
ref: bhorerkagoj
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.